২০২২-২৩ অর্থবছরে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে যে বাজেট ছিল ২৭ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছর (২০২১-২২) থেকে এক হাজার ৪১৮ কোটি টাকা কম পেলো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ৫১তম জাতীয় বাজেট অধিবেশনে এ বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এটি আওয়ামী লীগ সরকারের ২৩তম, দেশের ৫১তম ও বর্তমান অর্থমন্ত্রীর চতুর্থ বাজেট।
বাজেট অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে। তবে জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের যে ঘাটতি হবে তা দাম বাড়িয়ে ভোক্তাপর্যায়ে শতভাগ চাপানো হবে না।’ পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে স্বল্প ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনে টানাটানির মধ্যে আগামী অর্থবছরে প্রাকৃতিক গ্যাস, সার ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইঙ্গিত দিলেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট পেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিগত ১৩ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারের নিরলস প্রচেষ্টার ফলে দেশে সমপ্রতি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, পায়রা-গোপালগঞ্জ ৪০০ কেভি ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন এবং গোপালগঞ্জ-রামপাল ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন দুটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে ইতোমধ্যে কমিশনিং করা হয়েছে। এছাড়া মোংলা-খুলনায় ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন নির্মিত হয়েছে। গোপালগঞ্জ-আমিনবাজার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের ৭ দশমিক ৫ কিলোমিটার পদ্মা রিভার ক্রসিং অংশের পদ্মা রিভার বেডের সাতটি টাওয়ারের ফাউন্ডেশনের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওয়ার ইভ্যাকুয়েশনের জন্য ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভি ভোল্টেজের ছয়টি সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
করোনা-পরবর্তী বৈশ্বিক পুনরুদ্ধারের কারণে হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০২১ সালের শেষভাগ থেকেই আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। বর্তমানে দেশে আবিষ্কৃত ২৮টি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ২০টিতে উৎপাদন চলছে।
২০০৯ সালে দেশে দৈনিক এক হাজার ৭৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদিত হতো যা বেড়ে বর্তমানে দুই হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুট হয়েছে। পাশাপাশি গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে দৈনিক প্রায় ৬০০-৭৫৩ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) হিসেবে আমদানিপূর্বক রিগ্যাসিফাই করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হচ্ছে।
দেশের জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের শোধন ক্ষমতা আরও ৩০ লাখ টন বৃদ্ধির জন্য ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। আমাদের মূল কৌশল হবে বিদ্যমান চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে সরবরাহ বৃদ্ধি করা।
সে লক্ষ্যে আমদানি-নির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা হ্রাস করা। নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি হ্রাস করা হবে এবং একই সময়ে উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করা হবে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে ও স্বল্প আকারে সমন্বয় করা হবে।
পরিসংখ্যান তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, মে ২০২১-এর তুলনায় মে ২০২২ সময়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির হার প্রায় ৬৫ শতাংশ, ইউরিয়া সারের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ১১৪ শতাংশ, সয়াবিন তেলের মূল্যবৃদ্ধির হার ২৯ শতাংশ, গমের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ৮৫ শতাংশ এবং চিনির মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে ১৩ শতাংশ।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়ার কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ৯টি পণ্যের যেমন- জ্বালানি তেল, এলএনজি, গম, রাসায়নিক সার, পাম অয়েল, সয়াবিন তেল, কয়লা, ভুট্টা ও চাল একই পরিমাণে আমদানি করতে বাংলাদেশকে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে সম্ভাব্য অতিরিক্ত ব্যয় হিসেবে ৮.২ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার পরিশোধ করতে হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি অত্যন্ত বেগবান হওয়ায় আমদানি রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে আমাদের চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সুতরাং, আমাদের স্থানীয় বাজারে মার্কিন ডলারের চাহিদা বৃদ্ধিজনিত কারণে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, গ্যাস, জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস শুরু হয়ে যায়।’ সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কোভিডের কারণে দারিদ্র্য বেড়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ তো বাড়াতেই হবে।
পাশাপাশি সুষ্ঠুভাবে তা বিতরণের ব্যবস্থাও করতে হবে। আবার সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে। কারণ, বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় আমাদের সরকারি ব্যয় কম। বাজেটে সঙ্গত কারণেই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি খাত, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষাসহ বেশকিছু খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।’
কোভিড-১৯ অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকার হচ্ছে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এবারের বাজেটের আকার যেমন বড়, তেমনি এ বাজেটে ঘাটতিও ধরা হয়েছে বড়। অনুদান বাদে এই বাজেটের ঘাটতি দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশের সমান। আর অনুদানসহ বাজেট ঘাটতির পরিমাণ দুই লাখ ৪১ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ৪০ শতাংশের সমান।